তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিটি (ইঃ) কটন যুগে পদার্পণ
ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা১ অসীম চন্দ্র শিকদার২
বাংলাদেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। দেশে বর্তমানে ৪৫০টি স্পিনিং মিল রয়েছে যার জন্য বার্ষিক ৯ মিলিয়ন বেল আঁশ তুলার প্রয়োজন। দেশে উৎপাদিত হয় মাত্র দুই লক্ষ বেল (১ বেল প্রায় ৪৮০ পাউন্ড) তুলা। বাকি তুলা আমদানি করতে বছরে প্রায় ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সুতি কাপড় ও তৈরি পোশাক উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তুলার ব্যবহার ও আমদানির বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো মূলত কৃষিনির্ভর; তাই দেশে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। যদিও গত দশ বছরে দেশে উচ্চফলনশীল জাত এবং হাইব্রিড জাতের তুলা চাষাবাদের ফলে তুলার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; তবে তা দেশের চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম।
তুলা উন্নয় বোর্ড ২০৪১ সালের মধ্যে চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া নতুন জাত প্রবর্তন ও চাষ এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে তুলার উৎপাদন পাঁচগুণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে তুলা চাষের একটি প্রধান অন্তরায় হলো পোকামাকড়ের আক্রমণ; ফলে তুলা চাষে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের আবহাওয়া তুলার ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল; পোকামাকড়ের আক্রমণের ফলে কোন কোন জমির তুলার উৎপাদন অনেক সময় শূন্যের কোটায়ও চলে আসে। এ ছাড়া তুলার পোকা দমনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই পোকামাকড় প্রতিরোধী বিটি জাতের তুলার চাষাবাদ প্রচলন করার চেষ্টা তুলা উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘ দিন ধরে করে আসছিল। আশার কথা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষিবান্ধব সরকার বিটি কটন চাষের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ডকে অনুমতি প্রদান করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইঘঞঈঈই এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি হায়দরাবাদভিত্তিক কোম্পানি ঔক অমৎরমবহবঃরপং-এর বিটি কটনের দুটি হাইব্রিড জাত বাংলাদেশে চাষের জন্য অনুমোদন দান করেছেন এবং সেই সংগে হাইব্রিড জাতের পর তুলা উন্নয়ন বোর্ড হাইব্রিড বিটি কটনের যুগে পদার্পণ করল।
বাংলাদেশের জন্য বিটি কটনের উপযোগিতা : বাংলাদেশে চাষের জন্য অনুমোদিত হাইব্রিড বিটি কটনের দুুুুুুুুুুুুুুুুুুু’টি জাতের ট্রায়ালে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। দেখা গেছে- প্রচলিত জাতের তুলার উৎপাদন যেখানে হেক্টরে ৩ টন, সেখানে হাইব্রিড বিটি কটনের জাত দু’টির উৎপাদন হেক্টরে ৪ টনেরও বেশি। ফলে বাংলাদেশের তুলা চাষিরা হেক্টরে অতিরিক্ত ১ লক্ষ টাকা আয় করতে পারবেন। এ ছাড়া তাদের আর পোকামাকড়ের সাথে লড়াইও করতে হবে না, ফলে বাড়তি উৎপাদন খরচও হবে না। এ ছাড়া বিটি তুলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির জন্য উপযোগী। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিজ্ঞানী ড. এমডি. কামরুল ইসলাম যিনি বিটি কটন ট্রায়ালে জড়িত ছিলেন তিনি বলেন, বিটি কটনের জাত দুটি বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব। তাই বলাই যায় বাংলাদেশে বিটি কটন চাষ করে সাফল্য লাভের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
বিটি কটন : জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম (এগঙ) কটনকে বিটি কটন বলে অর্থাৎ জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং এর মাধ্যমে জিনগতভাবে বিবর্তিত কীটপতঙ্গ প্রতিরোধকারী উদ্ভিদই হলো বিটি কটন। অন্যভাবে বলা যায় এটি একটি জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড ক্রপ যে’টি উদ্ভিদের দেহে শুঁককীট বা লার্ভার মতো পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তুলাগাছ নিজেই কীটনাশক তৈরি করে নিতে পারে। বিটি (ইধপরষষঁং ঃযঁৎরহমরবহংরং) নামক একটি সাধারণ মাটির ব্যাকটেরিয়ার জিনের একটি স্ট্রেইন উদ্ভিদ দেহে ২০০টির বেশি বিটি টক্সিন তৈরি করতে পারে যা বিভিন্ন পোকামাকড়ের জন্য ক্ষতিকারক। উক্ত ব্যাকটেরিয়ার জিনের স্ট্রেইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির সাহায্যে তুলা গাছে প্রবেশ করিয়ে বিটি কটন তৈরি করা হয়। জিন ট্রান্সপারের মাধ্যমে বিটি কটন তৈরি হয় বলে একে ট্রান্সজেনিক কটনও বলা হয়ে থাকে।
বিটি কটনের বৈশিষ্ট্য : বিটি কটনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-তুলার সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা (খধঢ়রফড়ঢ়ঃবৎধ) বোলওয়ার্ম, (ঝঢ়ড়ফড়ঢ়ঃবৎধ) আঁচা পোকা অর্থাৎ সকল ধরনের শুঁয়োপোকা বা শুঁককীট প্রতিরোধী। এছাড়া বিটি কটনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হলো-উচ্চফলনশীল, দীর্ঘতন্তু বিশিষ্ট, উৎকৃষ্ট মানের এবং তুলনামূলক স্বল্প জীবনকাল। এছাড়া এ জাতের তুলায় ব্যাপক অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে; অর্থাৎ প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে।
চাষাবাদ প্রক্রিয়া : বিটি কটন চাষ হাইব্রিড তুলা চাষের অনুরূপ। বিটি কটন আগাম চাষ করা ভালো। বিশেষ করে জুলাই মাসের মধ্যে চাষ করলে ভাল হয়। জৈবসার যুক্ত বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটি বিটি কটন চাষের জন্য উপযুক্ত। বীজ আমদানিকৃত এবং মূল্য বেশি, তাই যত্ন সহকারে প্রতি মাদায় একটি করে বীজ হাফ ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি মাটির গভীরে বপন করতে হবে। জমির উর্বরা শক্তি বিবেচনা করে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৯০ সেমি., বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৪৫-৬০ সেমি. রাখতে হবে। ফলে বিঘা প্রতি বীজের প্রয়োজন হবে ৬০০ গ্রাম। তবে জমির উর্বরতা এবং বপন সময়ের উপর ভিত্তি করে লাইন ও বীজের দূরত্ব কম বেশি হতে পারে। বপনের সময় কিছু বীজ পলিব্যাগে বপন করে রাখলে ভালো হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সব বীজ নাও গজাতে পারে। তাই প্রয়োজনে পলিব্যাগের চারা দিয়ে গ্যাপ পূরণ করা যাবে। ভাল ফলন পেতে হলে, বিঘাপ্রতি কমপক্ষে ৪০০০টি গাছ নিশ্চিত করতে হবে।
বিঘাপ্রতি সারের মাত্রা ও প্রয়োগ : গোবর বা কম্পোস্ট সার ৬০০-৮০০ কেজি শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করে তুলা বীজ বপন করতে হবে। ব্যাসাল সার হিসেবে টিএসপি/ডিএপি ২০-২৫ কেজি, ইউরিয়া ৭-৮ কেজি, জিপসাম ৭ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১ কেজি বপনকৃত তুলা বীজ থেকে ৫-৬ সেমি. দূর দিয়ে নালায় প্রয়োগ করতে হবে। তুলাগাছের জীবনকালে তিন থেকে চার বার রাসায়নিক সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পার্শ্ব প্রয়োগ করা যেতে পারে। তুলা গাছের বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে ইউরিয়া ৭-৮ কেজি, এমওপি ২০-২৫ কেজি, বোরাক্স ১ কেজি, জিংকসালফেট ১ কেজি তুলার লাইন থেকে ৫-৬ সেমি. দূর দিয়ে নালায় প্রয়োগ করতে হবে। তুলার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে ২য় বার ইউরিয়া ১০-১১ কেজি, টিএসপি/ডিএপি ১৫ কেজি, এমওপি ২০-২৫ কেজি, জিপসাম ১২ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১ কেজি এবং জিংসালফেট ১ কেজি পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। তুলাগাছের বয়স ৬০ দিন হলে ইউরিয়া ১০-১১ কেজি, টিএসপি/ডিএপি ১৫ কেজি, এমওপি ১০ কেজি, জিপসাম ৬ কেজি, বোরাক্স ০.৫ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ১ কেজি এবং জিংসালফেট ১ কেজি পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় জমিতে রসের অভাব হলে সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে। তুলাগাছের বয়স ৭০-৮০ দিন হলে প্রয়োজনে ইউরিয় ৪-৫ কেজি পার্শ্ব প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে এ সময় হালকা সেচ দিতে হবে। ডিএপি প্রয়োগ করলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং ব্যাসাল ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে না। এছাড়া ৩/৪ বার রাসায়নিক সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফলিয়ার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করলে ফলন ৪ থেকে ৫% বৃদ্ধি পাবে। হরমোন স্প্রেও করা যেতে পারে।
বিটি তুলা যেহেতু পোকামাকড় প্রতিরোধী, তাই পোকমাকড় দমনের জন্য চাষি ভাইদের বাড়তি খরচ হবে না। তবে তুলার প্রাথমিক পর্যায়ে এফিড এবং তুলার শেষ জীবনকালে সাদা মাছির আক্রমণ হতে পারে। প্রয়োজন হলে কীটনাশক প্রয়োগ করে এ সকল পোকা দমণ করতে হবে। কারণ বিটি কটন এফিড ও সাদা মাছির উপর কোন ক্রিয়া করে না। বিটি কটন চাষে আইপিএম বা আইসিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভাল হয়। বিটি তুলার জীবনকাল হাইব্রিড জাতের মতোই, ১৭০-১৮০ দিন।
সীমাবদ্ধতা : জেনেটিক উদ্ভিদ তথা বিটি কটন বিভিন্ন প্রজাতির সঙ্গে সহজে বিবর্তন (ঊাড়ষঁঃরড়হ) ঘটাতে পারে। এছাড়া এফিড এবং সাদা মাছির মতো কীটপতঙ্গ থেকে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা নেই বিটি কটনের। তবে বাংলাদেশে তথা উপমহাদেশে তুলার এত প্রজাতি নেই যে, জেনেটিক তুলা চাষের কোন অন্তরায় সৃষ্টি করবে। চাষি ভাইদের এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারণ কর্মীদের এফিড এবং সাদা মাছির মতো পোকার আক্রমণের প্রতি সজাগ থাকতে হবে। উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষেত্রে বিটি কটন হুমকি হতে পারে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
হাইব্রিডের তুলনায় বিটি কটন চাষিদের জন্য লাভজনক হলে তবেই তুলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্দেশ্য সফল হবে। হাইব্রিডের পর বিটি কটনের যুগে পদার্পণের ফলে তুলা উৎপাদনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেকটাই সহজ হবে আশা করা যায়। তবে এখন আমাদের প্রধান কাজটি হবে বিটি কটনের বীজের মূল্য সুলভ এবং সহজ প্রাপ্য করা। কারণ হাইব্রিড চাষেরও প্রধান অন্তরায় অধিক বীজের মূল্য। প্রয়োজনে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বীজ আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে অথবা বীজের মূল্যে ভর্তুকি প্রদান করে স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মাঝে বীজ সরবরাহ করতে হবে। সেই সাথে আমাদের গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে হাইব্রিডের মতো বিটি কটনের বীজও উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
“দেশের মঙ্গল তুলা চাষে-বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে”
লেখক : ১প্রকল্প পরিচালক, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ঢাকা। ২কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ১০৪/১ (বি-২), শেরে বাংলা রোড, রায়ের বাজার, জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭, মোবাইল : ০১৫৫২-৩৬২৯০১, ই- মেইল: asim.cdb@gmail.com